সোনালি আঁশ পাটের সুযোগ আমরা নিতে পারছি না। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে দীর্ঘ দিন ধরে টানা লোকসান দেয়ার পর পাটকলগুলো আর রাষ্ট্রায়ত্ত থাকছে না। শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে পাওনা-দেনা মিটিয়ে দেয়া হবে। এ ব্যাপারে সরকারের প্রস্তুতিও রয়েছে। শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য পাওনা পেলে বিষয়টির একটি সুরাহা হবে। কিন্তু সোনালি আঁশের সম্ভাবনা কেন আমরা কাজে লাগাতে পারছি না এর একটি আদ্যোপান্ত গবেষণা আমাদের থাকা দরকার। কৃত্রিম তন্তু ব্যবহারের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাবের কথা সবার জানা। এ অবস্থায় পাটের মতো প্রাকৃতিক তন্তু দিয়ে তৈরি জিনিসপত্রের প্রাচুর চাহিদা থাকার পরও আমরা তা কাজে লাগাতে পারছি না। এখন পাটকলগুলো সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিই) ভিত্তিতে চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। সরকারি মালিকানায় পাটকলগুলো সব সুবিধা নিয়েও কেন লোকসানি ছিল; এর থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন পথযাত্রা শুরু করা দরকার।
পাটকল শ্রমিকরা তাদের বেতন ভাতার দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলেন। গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের ঘোষণা দিয়েছে সরকার; কিন্তু সেটি সততার সাথে বাস্তবায়ন করতে হবে। ২৫ হাজার শ্রমিকের পরিবার এর সাথে জড়িত। ইতোমধ্যে শ্রমিকদের পরিবারের দুরবস্থা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে আলোচনা হয়েছে। পাটকলগুলো লোকসান দেয়ার দায়ভার কোনোভাবে শ্রমিকদের নয়। সরকারের পক্ষ থেকে যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ছিলেন তাদের অযোগ্যতার কারণে এগুলো লাভের মুখ দেখেনি, এ ব্যাপারে সবার মধ্যে আলোচনা রয়েছে। এর সাথে রয়েছে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ। শ্রমিকরা শ্রম দিতে পারেন। তারা যদি নিজের কাজে ফাঁকি দেন সে জন্য ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। সে সুযোগ কর্তৃপক্ষের সবসময় ছিল। কিন্তু যাদের ব্যর্থতায় পাটকলগুলো লাভের মুখ দেখেনি তাদের জবাবদিহি কতটুকু নেয়া হয়েছে; সে সম্পর্কে কোনা কিছু জানা যায় না। এখন শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের দুর্নীতি যাতে না হয়; সেটি সরকারকে কঠোরভাবে নজরদারি করতে হবে।
নতুন করে পাটকলগুলো চালু হলে স্বাভাবিকভাবে পুরনো দক্ষ শ্রমিকরা কাজ পাবেন। পাটশিল্পের স্বার্থে তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব জানিয়েছেন, ৪৮ বছরে পাট খাতে ১০ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা লোকসান দিতে হয়েছে। সরকার পাটকলে আর লোকসানের ঘানি টানতে চায় না। সরকারের এ ধরনের বোধোদয়কে অবশ্যই স্বাগত জানানো উচিত। এর সাথে আরো কিছু ভাবনার বিষয় রয়েছে। এত সম্ভাবনাময় খাত থেকে বিপুল আয় না আসুক; অন্তত কেন টিকে থাকতে পারল না। আগের কথা না হয় বাদ দেয়া গেল, নতুন করে চার দিকে যখন পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে তখন থেকে কেন পাটকল লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা গেল না; যেখানে বেসরকারি পাটগুলো লাভ করছে, আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের চাহিদা বাড়ছে। সচিব যে পরিমাণ লোকসানের কথা বলছেন, দেশের দুর্নীতি ও ব্যাংক থেকে টাকা হাওয়া হয়ে যাওয়ার তুলনায় সেটি কোনো বড় অঙ্কের টাকা নয়।
ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ পাট উৎপাদনের উপযুক্ত জায়গা। এ সম্পদ পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের ততটা নেই। পরিবেশ রক্ষার যে আন্দোলন চার দিকে উঠেছে এ অবস্থায় পাটের সম্ভাবনা বিপুল। আমাদের সীমিত সম্পদের মধ্যে পাটের অর্থনৈতিক সুবিধা কাজে লাগাতে হবে। সরকার আপাতত লোকসানের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে পাটকল আর রাখছে না, কিন্তু পাটের সম্ভাবনা কাজে লাগানোর সুযোগ থেকে পিছু হটা চলবে না। পাট নিয়ে যখন কথা উঠছে আমরা দেখছি এ দেশে পলিথিনের ব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে। এর ব্যবহার করে আমাদের প্রকৃতিকে নিজেরাই ধ্বংস করছি। সরকার নিজের কর্মকা-ে বিপুল পলিথিনের ব্যবহার করে থাকে। শুধু সরকার যদি পাটপণ্য ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে দেয়; পাটকল চালানো লাভজনক হয়ে উঠতে পারে। একইভাবে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ না করে শুধু সীমিত করা হলে সেটিও পাটপণ্য ব্যবহার বাড়াবে। এভাবে নীতিগত কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার পাটের সোনালি অতীত ফিরিয়ে আনতে পারে।
Leave a Reply